পশম বা উল ফাইবার
টেক্সটাইল ‘র’ ম্যাটেরিয়ালস-১
বিষয় কোডঃ ১৯১১
অধ্যায়ঃ ৭
পশম বা উল ফাইবার
টেক্সটাইল শিল্পের মূল চালিকাশক্তি হলো সুতা । আর সেই সুতা তৈরী হয় ফাইবার থেকে । তবে সব ফাইবার ই টেক্সটাইল শিল্পের জন্য ব্যাবহারযোগ্য নয় । যে সকল ফাইবারের মধ্য সুতা তৈরীর সকল গুণাবলী থাকে তাদেরকেই আমরা টেক্সটাইল ফাইবার হিসেবে বিবেচনা করি । টেক্সটাইল ফাবারসমূহকে মূলত দুইভাগে ভাগ করা হয় যেমনঃ প্রাকৃতিক ফাইবার এবং মানবসৃষ্ট ফাইবার ।
উল ফাইবার হলো এক প্রকার প্রাকৃতিক ফাইবার । উল ফাইবার মূলত আলফা-কেরাটিন সমৃদ্ধ প্রোটিন ফাইবার । এই ফাইবার ভেড়ার লোম থেকে সংগ্রহ করা হয় । তবে ভেড়ার পাশাপাশি কিছু প্রজাতির ছাগল যেমন মোহাইর, কাশ্মীরী ছাগল এছাড়াও খরগোশ, উট এদের দেহের লোম হতে পাওয়া যায় । উল ফাইবার প্রাচীন ফাইবারসমূহের মধ্য একটি । সাধারণত গরম পোশাক তৈরীতে এই ফাইবার বেশ সমাদৃত ।
এছাড়াও আকর্ষনীয় ও ব্যায়বহুল পোশাক তৈরীতেও উল ফাইবার খ্যাতিসম্পন্ন । টেকসই গুণসম্পন্ন, নবায়নযোগ্যতা, আকর্ষণীয় পোশাক তৈরী এবং বিশেষ কিছু বৈশিষ্ট্যাবলী উল ফাইবারকে নিয়ে গিয়েছে মানুষের চাহিদার কেন্দ্রবিন্দুতে ।
উল ফাইবারের প্রকারভেদঃ
মূলত দুইটি উপায়ে উল ফাইবারের শ্রেনীবিন্যাস করা হয়ে থাকে
ক) ভেড়ার ধরণের ভিত্তিতে এবং
খ) ভেড়ার লোমের প্রকৃতির ভিত্তিতে ।
ক) ভেড়ার ধরণের ভিত্তিতে চার প্রকারের উল ফাইবার দেখা যায়ঃ
১) মেরিনো উলঃ এই ধরণের উল মূলত শক্তিশালী, সূক্ষ্ম, ইলাস্টিক প্রকৃতির হয়ে থাকে । ফাইবারের দৈর্ঘ্য ১-৫ ইঞ্চি পর্যন্ত হয়ে থাকে । এ জাতীয় ভেড়া মূলত স্পেন, নিজিল্যান্ড, দক্ষিন আমেরিকা, দক্ষিন আফ্রিকা, অস্ট্রেলিয়া এই দেশগুলোতে পালিত হয় । এই জাতীয় উল সবথেকে ভালো ফাইবার হিসেবে পরিচিত ।
২) ক্লাস-২ উলঃ এই ধরণের উল ও শক্তিশালী, সূক্ষ্ম, ইলাস্টিক প্রকৃতির হয় । তবে দৈর্ঘ্য ২-৮ ইঞ্চি পর্যন্ত হয় । এই জাতীয় ভেড়ার উৎস ইংল্যান্ড, স্কটল্যান্ড, আয়ারল্যান্ড, ওয়ালস এই দেশগুলো ।
৩) ক্লাস-৩ উলঃ এই ধরণের উল তুলনামূলক কম শক্তিশালী তবে মসৃন হয় । ফাইবারের দৈর্ঘ্য ৪-১৮ ইঞ্চি পর্যন্ত হতে পারে । যুক্তরাজ্যর দেশসমূহ মূলত এই ধরণের ভেড়ার প্রধান উৎস ।
৪) ক্লাস-৪ উলঃ এই ধরণের উল একদমই দূর্বল নমনীয়তা প্রদর্শন করে তবে মসৃন হয় । ফাইবারের দৈর্ঘ্য ১-১৬ ইঞ্চি পর্যন্ত হয় । উপমহাদেশে মূলত এই জাতীয় ভেড়ার দেখা মিলে ।
খ) ভেড়ার লোমের প্রকৃতির ভিত্তিতে মূলত পাঁচ ভাগে ভাগ করা যায়ঃ
১) ল্যাম্ব উলঃ ভেড়া থেকে প্রথমবার সংগৃহীত উল ই মূলত ল্যাম্ব উল হিসেবে পরিচিত । ভেড়ার বয়স ৬-৮ মাস হলে এই উল সংগ্রহ করা হয় ।
২) হগ উলঃ ভেড়ার বয়স ১২-১৪ মাসের সময় যে উল সংগ্রহ করা হয় তা হগ উল নামে পরিচিত । এই ধরণের উল শক্তশালী এবং ঘন হয়ে থাকে ।
৩) ওয়েদার উলঃ একটি ভেড়া থেকে প্রথমবার উল সংগ্রহ করার পর যখন আবার দ্বিতীয়বার এবং তার পরবর্তীতে উল সংগ্রহ করা হয় তখন সেই উল কে ওয়েদার উল বলে থাকে ।
৪) পুলড উলঃ কোন ভেড়া যখন জবাই করা হয় তখন তার শরীর থেকে উল সংগ্রহ করলে সে উলকে পুলড উল বলে ।
৫) ডেড উলঃ কোন ভেড়া মারা গেলে তখন সেই দেহ থেকে উল সংগ্রহ করা হলে সেসব উল ডেড উল হিসেবে পরিচিত ।
উল ফাইবার প্রক্রিয়াকরণঃ
১) ফাইবার সংগ্রহ: ভেড়ার দেহ থেকে ফাইবার সংগ্রহ করা হয়ে থাকে ।
২) বাছাইকরণ: ভেড়ার শরীরের বিভিন্ন অংশ হতে সংগৃহীত ফাইবার আলাদা করার মাধ্যমে বাছাই করা হয় ।
৩) স্কাওরিং: উল ফাইবার হতে বিভিন্ন অপদ্রব্য দূর করা হয় । এই প্রক্রিয়ায় পানি, ডিটারজেন্ট এবং ক্ষার ব্যাবহৃত হয় ।
৪) কার্বোনাইজিং: উলের মধ্য বিভিন্ন প্রকারের উদ্ভিজ্জ অংশ বিদ্যামান থাকে । তা দূর করতেই মূলত কার্বোনাইজিং প্রক্রিয়া সম্পন্ন করা হয় । এই প্রক্রিয়ায় জলীয় সালফিউরিক এসিড ব্যাবহৃত হয় ।
৫) গ্রেডিং: উল ফাইবারের প্রকৃতির উপর ভিত্তি করে তাদের গ্রেডিং করা হয় । ১-৪ নাম্বারের ভিত্তিতে গ্রেডিং হয়ে থাকে । এখানে উলের সূক্ষ্মতা, ক্রিম্প, রঙ, মসৃণতা ইত্যাদি বিবেচনা করা হয় ।
৬) বেইলিং: উল ফাইবারসমূহকে প্রক্রিয়াকরণের পর বেইল এর মাধ্যমে সংরক্ষণ এবন স্থানান্তর করা হয় । এক বেইলে সাধারণত ৩০০-৩৩০ কেজি পর্যন্ত উল ফাইবার সংকুচিত করে সংরক্ষণ করা হয় ।
উল ফাইবারে বিদ্যমান রাসায়নিক উপাদা্নঃ
১) কেরাটিন – ৩৩%
২) ধূলিকণা – ২৬%
৩) সুইন্ট – ২৮%
৪) চর্বি – ১২%
৫) খনিজ পদার্থ – ১%
উল ফাইবারের বৈশিষ্ট্যঃ
১) উল ফাইবারের প্রসার্য শক্তি প্রতি বর্গ ইঞ্চিতে ১৭০০০-২৯০০০ পাউন্ড হয় ।
২) উল ফাইবারের ইলাস্টিক পুনরুদ্ধার ক্ষমতা ২% বৃদ্ধিতে ৯৯% এবং ২০% বৃদ্ধিতে ৬৩% হয় ।
৩) উল ফাইবারের আপেক্ষিক গুরুত্ব ১.৩২ ।
৪) আদ্রতা পুণরুদ্ধার ক্ষমতা ১৬% ।
৫) ১৩০ ডিগ্রি সে. তাপমাত্রায় ফাইবার ভেঙে যায় এবং হলুদ হয়ে যায় ।
৬) অতিরিক্ত সূর্যের আলোয় হলুদাভ এবং রুক্ষ্ম হয়ে যায় ।
৭) উত্তপ্ত সালফিউরিক এসিড এ ফাইবার ভেঙে যায় ।
৮) তীব্র ক্ষারের সংস্পর্শে ফাইবার ভেঙে যায় ।
৯) পোকামাকড় দ্বারা সহজেই আক্রান্ত হয় ।
১০) অনুজীব এর বিরুদ্ধে শক্ত প্রতিরোধ ব্যাবস্থা রয়েছে ।
উল ফাইবার এর সুবিধাঃ
১) নবায়নযগ্য এবং টেকসই ।
২) শিখা প্রতিরোধী ।
৩) অতবেগুণী রশ্মি প্রতিরোধী ।
৪) উচ্চ তাপ এবং স্থির বিদ্যুৎ প্রতিরোধী ।
৫) ভালো শ্বসন উপোযোগী ।
৬) আদ্রতা নিয়ন্ত্রক ।
৭) এলার্জি প্রতিরোধী এবং শব্দ হ্রাসকারী ।
উল দ্বারা তৈরী সুতার প্রকারভেদঃ
উল দ্বারা মূলত দুই ধরনের সুতা প্রস্তুত করা হয় ।
১) ওলেন সুতাঃ এই ধরণের সুতা পুরু হয় এবং হালকা টুইস্ট দেওয়া থাকে । এসব সুতা দিয়ে পুরু ফ্যাব্রিক তৈরী করা হয় ।
২) ওরস্টেড সুতাঃ এই ধরণের সুতা ওলেন সুতা থেকে সূক্ষ্ম, মসৃণ এবং শক্তিশালী হয় । এতে টুইস্ট এর পরিমাণ ও বেশি থাকে । যেকোন ধরণের সুন্দর এবং আরামদায়ক পোশাক তৈরীতে ব্যাবহৃত হয় ।
ব্যাবহারঃ
১) পোশাকঃ সোয়েটার, কোর্ট, স্যুট, জ্যাকেট, প্যান্ট, স্কার্ট, ব্লাউজ, শার্ট ইত্যাদি ।
২) গৃহসজ্জাঃ কার্পেট, কম্বল এবং বিবিধ গৃহসজ্জার সামগ্রী ।
উৎপাদনঃ
প্রতিবছর বিশ্বে প্রায় ২ মিলিয়ন টন উল উৎপাদিত হয় যার ৬০% পোশাক তৈরীতে ব্যাবহৃত হয় । আন্তর্জাতিক টেক্সটাইল মার্কেটে ৩% অন্তর্ভুক্তিতে রয়েছে উল ফাইবার । একনজরে সর্বোচ্চ উৎপাদিত দেশ সমূহঃ
১) অস্ট্রেলিয়া – ২৫%
২) চায়না – ১৮%
৩) যুক্তরাষ্ট্র – ১৭%
৪) নিউজিল্যান্ড – ১১%
৫) আর্জেন্টিনা – ৩%
৬) তুর্কি – ২%
৭) ইরান – ২%
৮) যুক্তরাজ্য – ২%
৯) ভারত – ২%
১০) সুদান – ২%
১১) দক্ষিণ আফ্রিকা – ১%
পশম বা উল ফাইবার নিয়ে বিস্তারিত :
আরও পড়ুন…